জমি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন? ভাবছেন খুব ভালো জমি। দরদামও আয়ত্তের মধ্যে। জমি
কেনার দলিল সম্পাদন করে নিলেই হলো। জমির মালিক হয়ে যাবেন। কিন্তু তড়িঘড়ি করে
কিনতে গিয়ে বিপদেও পড়তে পারেন।
জমি কেনার আগে জমির ক্রেতাকে জমির বিভিন্ন দলিল বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ
করে জমির মালিকের মালিকানা বৈধতা ভালো করে যাচাই করতে হবে। অন্যথায় জমি কিনতে
গিয়ে প্রতারণার শিকার হতে হবে। কিংবা জমির মূল অংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা
থাকবে।
মালিকানা যাচাই না করে জমি কিনলে ভবিষ্যতে মামলা-মোকদ্দমায়ও জড়িয়ে পড়ার
আশঙ্কা থাকে। মাঝেমধ্যে দেখা যায় একজনের নাম করা জমি অন্য একজন ভুয়া দলিল
দেখিয়ে বিক্রি করেছেন। পরে আসল মালিক ক্রেতাকে জড়িয়েও মামলা ঠুকে দেন। জমির
বিভিন্ন ধরনের দলিল থাকতে পারে। বিক্রয় দলিল থেকে শুরু করে ভূমি উন্নয়ন কর
খতিয়ান সবই হচ্ছে দলিল। ক্রেতাকে প্রথমেই দেখতে হবে সবশেষে যে দলিল করা হয়েছে,
তার সঙ্গে আগের দলিলগুলোর মিল আছে কি না। বিশেষ করে, ভায়া দলিলের সঙ্গে
সামঞ্জস্য আছে কি না, দেখতে হবে। ভায়া দলিল হচ্ছে মূল দলিল, যা থেকে পরের দলিল
সৃষ্টি হয়। ধরা যাক, আপনি কিছু জমি ১৯৯০ সালে ৪৭০ নম্বর রেজিস্ট্রি দলিলের
মাধ্যমে কেনেন। সেই জমি ২০০৮ সালে অন্য একজনের কাছে ৫২০ নম্বর রেজিস্ট্রি দলিলে
বিক্রি করলেন। তাহলে আগের ৪৭০ নম্বর দলিলটি হচ্ছে ভায়া দলিল।
হস্তান্তর করা দলিলে দাতা এবং গ্রহীতার নাম, ঠিকানা, খতিয়ান নম্বর, জোত নম্বর,
দাগ নম্বর, মোট জমির পরিমাণ ভালো করে দেখতে হবে। আরেকটি বিষয় খেয়াল করতে হবে,
যে ভায়া দলিল থেকে পরবর্তী দলিল করা হয়েছে, তাতে প্রতি দাগের হস্তান্তরিত জমির
পরিমাণ ঠিক আছে কিনা। অনেক সময় আগের দলিলের চেয়ে পরের দলিলে বেশি জমি দেখানো
হয়।
খতিয়ানের ক্ষেত্রে আগের খতিয়ানগুলোর সঙ্গে সর্বশেষ খতিয়ানের মিল আছে কি না, তা
মিলিয়ে দেখতে হবে।
মিউটেশন বা নামজারির মাধ্যমে যে খতিয়ান তৈরি করা হয়েছে, সে মতো খতিয়ানে দাগের
মোট জমির পরিমাণ এবং দাগের অবশিষ্ট পরিমাণ যোগ করতে হবে। এই যোগফল কোনো দাগে মোট
যে পরিমাণ জমি আছে, তার চেয়ে কম না বেশি, তা দেখা দরকার। যদি বেশি হয়, তবে
অতিরিক্ত জমির মালিকানা কোনোভাবেই দাবি করা যাবে না। দেখতে হবে মিউটেশন বা
নামজারি করা হয়েছে কি না এবং নামজারি যদি না হয় তাহলে কী কারণে হলো না তা জানতে
হবে। মিউটেশন না করা থাকলে জমি কিনতে সমস্যা হবে।
খেয়াল রাখতে হবে, দাগ নম্বরে সর্বমোট যে পরিমাণ জমি আছে, তার সঙ্গে আগের
দলিলগুলোর মিল আছে কি না। জমি যাঁর কাছ থেকে কিনবেন তিনি কীভাবে জমির মালিক
হয়েছেন, তা দেখতে হবে। ক্রয়সূত্রে, ওয়ারিশমূলে, দান বা হেবামূলে যেকোনো
উপায়েই হোক না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই উপযুক্ত দলিল যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে।
পাওয়ার অব অ্যাটর্নি মূলে যদি কেউ কোনো জমি বিক্রি করতে চান তাহলেও মূল মালিকের
সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাঁর কাছ থেকে প্রকৃত তথ্য জেনে নেওয়া উচিত। অনেক সময়
ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল তৈরি করে জমি বিক্রির ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। জমি
কেনার ক্ষেত্রে সেটা সরকারি মালিকানা বা অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত কি না,
অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে।
যেকোনোভাবেই হোক না কেন, জমির মালিকানা যাচাই না করে জমি কেনা বোকামি। অনেক সময়
জমিজমা নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলাকালে প্রকৃত তথ্য গোপন করেও অনেকে জমি বিক্রি করে
দেন। তাই মালিকানা-সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টি জেনে নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে
আশপাশের লোকজনদের কাছ থেকে জমি নিয়ে তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। অনেক সময়
জমি নিয়ে অগ্রক্রয়ের মামলাও হতে পারে। তাই পার্শ্ববর্তী জমির মালিক অগ্রক্রয়ের
দাবিদার কি না, তা খুঁজে বের করতে হবে। কোনোভাবে জমিজমা-সংক্রান্ত বিষয়ে তৃতীয়
পক্ষ বা মধ্যস্থতাকারীকে শতভাগ বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। ক্রেতা নিজেকেই
মালিকানা-সংক্রান্ত বিষয়ে ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে কিংবা যাচাই-বাছাই করে জমি
কিনতে হবে। না হলে মালিকানা-সংক্রান্ত একটু জটিলতা সারা জীবনের কান্নার কারণ হয়ে
দাঁড়াতে পারে আর মামলা-মোকদ্দমার হয়রানি তো আছেই।
মালিকানা স্বত্বের তদন্ত ও তল্লাশী
সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতার অবশ্য কর্তব্য হচ্ছে ক্রয়েচ্ছু
সম্পত্তির স্বত্বের তদন্ত ও তল্লাশী। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে বিক্রেতার নিকট
হতে প্রাপ্ত স্বত্ব সম্পৰ্কীয় দলিলাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।
বিক্রেতার বর্তমান মালিকানা স্বত্ব কিরুপে কবে এবং কতখানি বর্তাইয়াছে দেখতে হবে।
বিক্রেতা যদি ওয়ারিশানসূত্রে সম্পত্তির মালিক হন তাহা হলে তার পূর্ববর্তী
মালিকদের ধারাবাহিক ও বৎসরানুক্রমিক একটি তালিকা প্রস্ত্তত করা আবশ্যক। তদন্ত করে
দেখতে হবে বিক্রেতার পুর্ববর্তী মালিকের এই সম্পত্তিতে বৈধ মালিকানা স্বত্ব ছিল
কিনা। কিংবা থাকলেও সময় প্রবাহে তাদের মালিকানা স্বত্ব কোনরূপ খর্ব হয়েছে কিনা।
ওয়ারিশানসূত্রে প্রাপ্ত বিক্রেতার সম্পত্তির উপর অন্য কোন ওয়ারিশানের হক আছে
কিনা এবং তাকলে ছাহাম বন্টন হয়েছে কিনা। বিক্রেতা খরিদসূত্রে বিক্রয়ে সম্পত্তির
মালিক হলে, সে যার নিকট হতে সম্পত্তি খরিদ করেছে তাহার বৈধ মালিকানা-স্বত্ব ছিল
কিনা এবং থাকলে সঠিক রেজিষ্ট্রি করে স্বত্বান্তর করা হয়েছে কিনা। বিক্রেতার
মালিকানা-স্বত্ব সম্পর্কীয় চেক, পরচা, নকশা ইত্যাদি পরীক্ষার পর
সম্পত্তিসম্পর্কীত ইতিপূর্বে সম্পাদিত দলিল দস্তাবেজ যাহাকে 'বায়া দলিল' বলে
পরীক্ষা করতে হবে। ইতিপূর্বে দলিল দস্তাবেজ বলতে মূল দলিল, বন্টননামা, হেবা-নামা,
সালিশী আদালতে হুকুমজারী, ট্রাস্ট দলিল, ওয়াকফনামা, স্বত্ব প্রত্যার্পণ
সম্পর্কিত কোন দলিলাদি, উইলের প্রবেট ইত্যাদি বোঝায়। বিক্রেতার স্বত্বের প্রমাণ
হিসাবে দেওয়ানী আদালতের রায়ের কপি নামজারীর সইমোহরী কপি, সরকারী বা
স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রদত্ত কর বা খাজনার রসিদপত্র ইত্যাদি যাচাই করে
দেখা উচিত।
দখলী স্বত্ব
দলখ মালিকানা স্বত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিক্রেতাকে সম্পত্তির উপর গিয়ে সঠিকভাবে
নির্ধারণ করতে হবে বিক্রেতার সম্পত্তির উপর কার্যকরী দখল আছে কিনা। সম্পত্তিটি
যদি অন্য কাহারও দখরে থাকে তাহা হলে দখলকাররা কেন, কতদিন ও কি সূত্রে দখলে আছে
এবং তাহা বিক্রেতার স্বত্ব অবৈধ কিনা যাচাই করা উচিৎ।
তল্লাশী
ক্রেতার ক্রয়েচ্ছু সম্পত্তি তল্লাশী করা একান্তভাবে আবশ্যক। যে রেজিষ্ট্রেশন
অফিসের এখতিয়ারভূক্ত এবং রাজস্ব দফতরে সম্পত্তিটির কাগজপত্র সংরক্ষিত হয়, এই
উভয় স্থানে তল্লাশী করা উচিত। বিক্রেতা তার স্বত্ব প্রমাণের জন্য যে সকল কাগজ ও
দলিলাদী উপস্থাপন করে তা সঠিক কিনা সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে গিয়ে
পরীক্ষা করেই নিশ্চিত হওয়া যায় ।
রাজস্ব দফতর
রাজস্ব দফতরে তল্লাশী বলতে কালেক্টরেট, রাজস্ব সার্কেল অফিস, সাব-ডিভিশনাল
ম্যানেজার অপিস ও তহশিল অফিসে, যেখানে সম্পত্তিটির খাজনা প্রদত্ত হয় অনুসন্ধান
করা বোঝায়। এই সমস্ত দফতর তদন্ত করে এবং সইমোহরী কপি নিয়ে দেখতেহবে সম্পত্তিটি
বিক্রেতার নামে আছে কিনা। অবশ্য মনে রাখা আবশ্যক যে রাজস্ব দফতরে রক্ষিত
কাগজপত্রের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে এবং মালিকের নামজারী করিয়াও চেক পরছা পাইতে
অনেক সময় বিলম্ব হয়ে থাকে। এই ভুলভ্রান্তি বা বিলম্ব হেতু মালিকানা-স্বত্ব না
লোপ পেয়েছে এরূপ ধারণা করা ঠিক হবে না, যদি পর্যায়ক্রমে মালিকানা স্বত্ব ও দখল
সঠিক বলিয়া গণ্য হয়ে থাকে।
রেজিষ্ট্রেশন অফিস
বিক্রয়ে ইচ্ছুক সম্পত্তিটি যে রেজিষ্ট্রেশন অফিসের এখতিয়ারভূক্ত সেই অফিসে
তললাশী দিয়ে পরীক্ষা করা যায়, সম্পত্তিটি ইতিপূর্বে একই বিক্রেতা বা অন্য
কাহারও দ্বারা বিক্রয় হয়েছে কিনা। রেজিষ্ট্রেশন অফিসে তল্লাশী করবার নিমিত্ত
লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি থাকে, এসব ব্যক্তিকে 'সার্ভার' বলা হয়। দাগ নম্বর বা
দলিলদাতার নামের আদ্যক্ষর রেজিষ্ট্রেশন অফিসের যে ইনডেক্সে থাকা সম্ভব। একজন
সার্চার তল্লাশী করে বুঝতে পারবে দাগটি বিক্রয় হয়েছে কিনা, হয়ে থাকলে কতবার,
কার দ্বারা এবং বর্তমানে কার নামে আছে ইত্যাদি। তল্লাশী ইচ্ছানুযায়ী যে কোন
বৎসরের জন্য করা যায়, তবে স্থাবর সম্পত্তির তল্লাশী অনধিক বার বৎসরের জন্য করলে
উত্তম হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন