সোনার দাম ও বিক্রির নিয়ম জানুন | ভরি, ক্যারেট ও বাজার বিশ্লেষণ


আসসালামু আলাইকুম প্রিয় দর্শক - ল্যান্ড সার্ভে বিডি পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগতম। আজকে আমি আপনাদের মাঝে সোনার দাম ও বিক্রির নিয়ম জানুন | ভরি, ক্যারেট ও বাজার বিশ্লেষণ নিয়ে আলোচনা করব।

স্বর্ণের হিসাব বা সোনার হিসাব 

স্বর্ণ আন্তজাতিক বাজারে ট্রয় আউন্স এবং কেজি ও গ্রাম হিসাবে ক্রয়-বিক্রয় হলেও আমাদের দেশে পুরাতন তোলা, ভরি, আনা, রতিএবং পয়েন্টের হিসাবে চলে। এক ট্রয় আউন্স সমান ৩১.১০৩ গ্রাম আর এক কেজিতে ১০০০ গ্রাম। স্বর্ণ অনেক মূল্যবাদ ধাতু তাই এর ক্ষুদ্র একক গ্রামেই বেশি বিক্রি হয় খুচরা বাজারে। বিশ্ব বাজারে স্বর্ণের দাম দিনে দুইবার উঠানামা করলেও বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম ঠিক করে দেয় বাংলাদেশে জুয়েলাস সমিতি। আর্ন্তজাতিক বাজারের সাথে কিছুটা মিল রেখে এই দাম নির্ধারন করা হয়। বিশ্ববাজারে স্বর্ণের ওজন পরিমাপে গ্রাম বা আউন্স-ই বেশি ব্যবহার হয় অবশ্য অনেকেই জানেন না, যে কত গ্রাম বা আউন্স -এ কত ভরি হয়। এটা জানা থাকলে দেশ-বিদেশে স্বাচ্ছন্দে স্বর্ণ কেনাকাটা করা যায় একই সঙ্গে দামের পার্থক্যটাও ধরা পড়ে। সোনা ক্রয়ে সোনার দাম, মেকিং চার্জ এবং ভ্যাট পৃথক ভাবে দেখে নেয়া উচিত। সাথে সোনার ক্যারেত, ও ওজন ঠিক আছে কিনা তাও দেখা উচিত।

দেশীয় হিসাব স্বর্ণ পরিমাপের একক

আমাদের দেশে তোলা এবং ভরি বহুল প্রচলিত শব্দ স্বর্ণের হিসাবে। এই তোলা বা ভরির আরো ছোট এককগুলো হলো আনা, রতি এবং পয়েন্ট। এদের মাঝে হিসাবটা হলো 
  • ১ ভরি = ১৬ আনা (১ভরির ১৬ ভাগের এক ভাগকে এক আনা বলে)
  • ১ আনা = ৬ রতি (এক আনার ছয় ভাগের এক ভাগকে রতি বলে)
  • ১ রতি=১০পয়েন্ট (১ রতির দশ ভাগের এক ভাগকে ১পয়েন্ট বলে)
তাহলে, এক ভরি = এক তোলা = ১৬ আনা = ৯৬ রতি ৯৬০ পয়েন্ট = ১১.৬৬৪ গ্রাম।

পুরাতন হিসাবকে গ্রামে বুঝতে হলে উদাহরটি দেখুন

বিক্রেতা যদি বলে এই গহনায় ১ ভরি ৮ আনা ৫ রতি ৬ পয়েন্ট স্বর্ণ আছে তাহলে আপনি যে ভাবে বুজবেন কত গ্রাম আছে প্রথমে জেনে নিন 
১ ভরি = ১১.৬৬৪ গ্রামএখন বাকিটাকে গ্রামে নিয়ে আসবো।
সূত্রঃ [আনা/১৬+রতি/৯৬+পয়েন্ট/৯৬০] তাহলে হিসাবটি হবে 
(৮ আনা/১৬+৫রতি/৯৬+৬ পয়েন্ট/৯৬০) =.৫+.০৫২+.০০৬২৫) = ৫৫৮২৫ গ্রাম 
মোট ১১.৬৬৪+৫৫৮২৫গ্রাম= ১২.২৩ গ্রাম 

সোনার বিশুদ্ধতা

সোনার বিশুদ্ধতার একক ক্যারেট। ২৪ ক্যারেট সোনাকে ৯৯.৯৯% বিশুদ্ধ সোনা বলা হয়। বাজারে এই মানের সোনার গহনা হয়না। এটা সোনার বিস্কুট এবং বার হিসাবে বিক্রি হয়। এর সাথে অন্য ধাতু যেমন সিলভার, কপার এগুলো যুক্ত করে ডিজাইন তৈরি করা হয়। এই গুলোর মিশ্রণকে আমরা বলি খাদ। বাজারে ২২ ক্যারেট, ২১ ক্যারেট, ২০ ক্যারেট, ১৮ ক্যারেট, ১৪ ক্যারেট, ১৯ ক্যারেটেরও সোনাও পাওয়া যায়। এখানে ২৪ হলো আমাদের বিশুদ্ধতার মানদণ্ড তাই এর থেকে যত কম হবে সেই সোনায় তত খাত বেশি। ২২ ক্যারেট সোনা হলে এখানে ২ ক্যারেট খাত আছে আর ২০ ক্যারেট হলে এখানে ৪ ক্যারেট খাত বা অন্য ধাতু আছে। এই ভাবে আমরা বুঝবো সোনাটায় কতটা খাদযুক্ত আছে বা সোনাটা কতটুকু খাঁটি। ভরি, গ্রাম, কেজি এ সমস্ত যেমন মাপের একক-ঠিক তেমনি সোনা ২৪ ক্যারেট ধরে হিসাব করা হয়। ৯৬ রতিতে হয় ১ ভরি। সে হিসাবে ৯৬ কে ২৪ দিয়ে ভাগ করলে হয় ৪ রতি, আর এই ৪রতি সমান ১ ক্যারেট। তাই আমরা বলতে পারি একভরি সোনায় ২২ ক্যারটের সোনায় ৮ রতি খাদ বা অন্য ধাতু মিশ্রিত থাকে।

ক্যারেট অনুযায়ী বিশুদ্ধতার আন্তর্জাতিক তালিকা

  • সোনার ক্যারেট বিশুদ্ধতার পরিমাণ 
  • ২৪ ক্যারেট ৯৯.৯৯% পিউর;
  • ২২ ক্যারেট ৯১.৬০% পিউর অলংকারে খোদাই কৃত ৯১৬
  • ২১ ক্যারেট ৮৭.৫০% পিউর অলংকারে খোদাই কৃত ৮৭৫
  • ১৮ ক্যারেট ৭৫.০০% পিউর অলংকারে খোদাই কৃত ৭৫০
  • ১৪ ক্যারেট ৫৮.৫% পিউর
  • ১০ ক্যারেট ৪১.৭% পিউর।
যখনই স্বর্ণালংকার ক্রয় করা হবে অবশ্যই অর্ণামেন্টেস-এর গায়ে খোদাই করা ক্যারেট লেখা দেখে নেয়া উচিত। অর্ণামেন্টেস-এর গায়ে অথবা চেনের হুকে খোদাই করা লেখা থাকবে ৯১৬ অর্থাৎ ২২ ক্যারেট, ৮৭৫ অর্থাৎ ২১ ক্যারেট, ৭৫০ অর্থাৎ ১৮ ক্যারেট।

বিভিন্ন মেশিনে পরীক্ষা

আমাদের দেশের নানা দেশের সোনা বিক্রি হয়। ভারতের বি আই এস [BIS] হল মার্ক যুক্ত সোনাতে 'লিখা থাকে এটা কতটা বিশুদ্ধ। এছাড়া বাংলাদেশে সোনা গুলো বাংলা গোল্ড পাইভেট লিমিটেড নামক একটি কোম্পানি হল মার্ক করে দেয়। যদি এই সব হল মার্ক করা না থাকে তবে আপনি বিভিন্ন সোনার দোকানে বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের এক্সরে মেশিন থবা স্পেকট্রোমিটার পাবেন সেখানে যাচাই করে নেয়া ভালো।

বাংলাদেশে সোনার দাম

বাজার থেকে সোনা ক্রয়ে তিন প্রকারের খরচ যুক্ত হয়। প্রথমে ক্যারেট হিসাবে প্রতি গ্রামের দাম হিসাব করা হয়। পরে মোট কতটুকু সোনার অলংকার ক্রয় করলেন তার উপর মেকিং চার্জ ধরা হয়. সোনার দামের ৩%-৪% অথবা প্রতি গ্রামে সমিতি কতৃক নির্ধারিত ৩০০ টাকা। এখন এই মোট দামের উপর ৫% সরকারি ভ্যাট যুক্ত হয়। তবে তারা সোনার দাম, মেকিং চার্জ এবং ভ্যাট এ তিনটি একসাথে করে প্রতি গ্রাম সোনার দাম ঠিক করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা কার্যকর হবার সম্ভাবনা আছে।

অলংকার বিক্রি করলে টাকার অংকে ক্ষতি হয় কেন?

  • বিক্রির সময় দেখা যায়
  • প্রথমে সোনার ক্যারেট নিয়ে সন্দেহ করে
  • সোনা থেকে খাদ বাদ দেয়ার নাম করে ওজনে কমিয়ে পেলে
  • নীতিমালা অনুযায়ী বাজার মূল্য থেকে ১৫% সোনার দাম কম ধরা হয়
  • বিনিময়ের ক্ষেত্রে ৮% বাদ দেয়া হয়
  • আপনার আগের মেকিং চার্জ বাদ যায়
  • আর ভ্যাট তো স্বাভাবিক ভাবেই বাদ।

বিক্রির ক্ষেত্রে-সংশোধিত নিয়ম মোতাবেক

সোনার বাজার মূল্য থেকে ২০% বাদ দেয়ার নিয়ম ছিল পূর্বে এখন তা কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদি বাজার মূল্য ১০০ টাকায় হয় তাহলে পূর্বে ২০ টাকা বাদ দেয়া হতো এখন ১৫ টাকা বাদ দিয়ে ৮৫ টাকা দেয়া হবে।

বিনিময়ের ক্ষেত্রে

অনেক ক্ষেত্রে সোনা বিক্রি না করে এক অলংকার দিয়ে ভিন্ন অলংকার বিনিময় করা হয়। পূর্বে ১০% বাদ দেয়া হতো এখন ৮% বাদ দেয়া হবে। ১০০ টাকার সোনা হলে যদি বিনিময় করা হয় তাহলে ৮ টাকা বাদ দিয়ে ৯২ টাকা হিসাব করা হবে।
বাস্তব উদাহারণ
যদি আপনি ২২ ক্যারেট এর ১ ভরি সোনা কিনেন এবং বিক্রি করতে চান কত টাকা ক্ষতি হবে দেখে নিন
১ ভরি সোনার দাম = ৮৪৩৩১ টাকা
মেকিং চার্জ = ৩৪৯৯ টাকা
ভ্যাট = ৪৩৯১ টাকা
= ৯২২২০ টাকা মাত্র 

বিক্রির সময় সোনার দামের ১৫% বাদ দেয়া হবে
৮৪৩৩১ টাকার ১৫%= ১২৬৫০ টাকা
আপনি পাবেন তাহলে ৮৪৩৩১-১২৬৫০= ৭১৬৮১ টাকা মাত্র
একভরি সোনা বিক্রিতে আপনার ক্ষতি তাহলে (৯২২২০-৭১৬৮১) =২০৫৩৮ টাকা মাত্র 
পুরোনো অলংকার বিক্রিতে মুনাফা বেশি করতে চাইলে এবং যদি বিশ্বস্ত জুয়েলারি ব্যবসায়ী থাকলে অলংকার গলিয়ে পাকা/ভেজাবি সোনায় রূপান্তর করে বিক্রি করতে পারেন তাতে দাম পাবেন ভালো। 

স্বর্ণ নীতিমালা ২০১৮ (সংশোধিত ২০২১ পর্যন্ত) 

বর্তমানে সরকার অনুমোদিত ১৮টি প্রতিষ্ঠান এবং একটি ব্যাংককে বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণ অলংকার ভ্যাট ও শুল্কমুক্তভাবে সঙ্গে আনতে পারেন (ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য)। 

এছাড়াও, ২৩৪ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণের বার (প্রায় ২০ ভরি) আনতে পারেন, যেখানে প্রতি ভরিতে নির্ধারিত শুল্ক প্রায় ২,০০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়।

এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপকে আকরিক সোনা (raw gold ore) আমদানি ও দেশে পরিশোধন করে স্বর্ণের বিস্কিট আকারে রপ্তানির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যা দেশের প্রথম স্বর্ণ পরিশোধনাগার স্থাপনের পথ খুলে দিয়েছে।

বিশ্ব বাজারের সাথে দেশের সোনার দাম ১৫-২০ হাজার টাকা পার্থক্য থাকে কেন?

বিশ্ববাজারের তুলনায় বাংলাদেশে স্বর্ণের দামে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার পার্থক্য দেখা যায়।

বিশ্ববাজারে প্রতিদিন দুটি সময়ে স্বর্ণের দর ওঠানামা করে, আর বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (BAJUS) সেই দাম বিবেচনায় এনে দেশের বাজারে স্বর্ণের মূল্য নির্ধারণ করে। তবে এই নির্ধারিত দামের মধ্যে নানা কর, ভ্যাট, ব্যবসায়িক মুনাফা, আমদানি সীমাবদ্ধতা এবং ডলার রেটের কারণে ২২ ক্যারেট স্বর্ণে প্রতি ভরিতে ১৫-২০ হাজার টাকার বেশি পার্থক্য তৈরি হয়।

এই উচ্চমূল্যের সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিরা প্রবাসীদের প্রলুব্ধ করে। অনেক প্রবাসী ব্যক্তি প্রায় ১০০ গ্রাম অলংকার ও ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণবার দেশে আনেন, যেখানে তাদের বিনামূল্যে বিমান টিকিট এবং নগদ অর্থও দেওয়া হয়। ফলে তারা না বুঝেই চোরাচালান চক্রের অংশ হয়ে পড়েন।

এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকারের উচিত স্বর্ণের দাম নির্ধারণে আরও স্বচ্ছতা ও নজরদারি বাড়ানো।

প্রবাসীদের ক্ষেত্রে যদি কেউ নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোনা কেনা লাভজনক হতে পারে। কারণ সেখানে স্বর্ণের দাম তুলনামূলক কম এবং ক্যারেট সাধারণত নির্ভরযোগ্য থাকে।

পুরাতন সোনা বিক্রির নতুন কোন নীতিমালা নেই?

সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতা স্বর্ণ ব্যবসায়িদের সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়েছে, বিক্রির সময় প্রতি গ্রাম সোনার বাজার মূল্য হিসাবে বিক্রি করে সাথে মেকিং চার্জ এবং ভ্যাট যুকৃত হয় কিন্তু ক্রেতা বিক্রি করতে আসলে প্রথমে তারা ক্যারেট নিয়ে তালবাহানা করে, বলে ব্যবহারের ফলে ক্যারেট কমে গেছে, ২২ ক্যারেট ২১ ক্যারেট হয়ে গেছে। পরে সেই ক্যারেটের বর্তমান বাজার মূল্য না ধরে সেখান হেকে ১৫% কম মূল্য ধরা হয়। আবার কোথাও দেখা যায় স্বর্ণ থেকে তারা খাদ হিসাব করে বাদ দেয়। এই ভাবে প্রতিটি ব্যবসায়ী মানুষকে শোষন করছে। আশা করা যায় সরকার এই নিয়ে কোন নীতিমালা নিয়ে আসবে। ২০২২ সালের দিকে জুয়েলাস সমিতির নির্দেশনা থেকে দেখা যায় তারা সোনা বিক্রিতে বাজার দরের থেকে ১৫% এবং বিনিময়ের ক্ষেত্রে ৮% বাদ দেয়ার কথা বলা হয়েছে।


আপনি আসলেই ল্যান্ড সার্ভে বিডি একজন মূল্যবান পাঠক। সোনার দাম ও বিক্রির নিয়ম জানুন | ভরি, ক্যারেট ও বাজার বিশ্লেষণ এর আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই আর্টিকেলটি পড়ে আপনার কেমন লেগেছে তা অবশ্যই আমাদের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

পরবর্তী পোস্ট পূর্ববর্তী পোস্ট
🟢 কোন মন্তব্য নেই
এই পোস্ট সম্পর্কে আপনার মন্তব্য জানান

দয়া করে নীতিমালা মেনে মন্তব্য করুন - অন্যথায় আপনার মন্তব্য গ্রহণ করা হবে না।

comment url